আলুবোখারা চাষ পদ্ধতি

আলুবোখারা কলাম চারা 

 আলুবোখারা (Prunus domestica) বাংলাদেশের স্বল্প ব্যবহৃত একটি উচ্চমূল্যের মসলা ফসল। সপ্তদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে আলুবোখারার উন্নত জাতগুলো উদ্ভাবিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় শীত প্রধান ও অবউষ্ণ এলাকায় বিশেষ করে মধ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ তারপর উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, চীন, ভারত, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে আলুবোখারার আবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- ইংরেজিতে প্লাম, গেজ, গার্ডেন প্লাম, প্রুন, প্রুন প্লাম, বাংলাদেশ ও ভারতে আলুবোখারা এসব নামে ডাকা হয়।

      আশ্চর্য রকমের সুস্বাদু ও রসালো এ ফল ফ্রেশ খাওয়া চলে অথবা চিনি, মরিচ ও সরিষার তেল সহযোগে চাটনির মতো করে অথবা বিভিন্ন উপাদান যোগ করে রান্না করে খাওয়া হয়। আলুবোখারা দিয়ে জ্যাম, জেলি, চাটনি, কেক, আচার প্রভৃতি তৈরি করা যায়। মধ্য ইংল্যান্ডে সিডার জাতীয় অ্যালকোহলিক বেভারেজ যা প্লাম জাবকাস নামে পরিচিত তা আলুবোখারা থেকেই প্রস্তুত করা হয়। শুকনা আলুবোখারা (যা প্রুন নামে পরিচিত) মিষ্টি, রসালো এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এতে খাদ্য শক্তি কম (৪৬ কি.ক্যাল.) থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষ উপযোগী। এতে যথেষ্ট পরিমাণে পটাসিয়াম, ফ্লোরাইড ও লৌহ রয়েছে যা দেহকোষের সুরক্ষার জন্য উপযোগী। এর অন্যান্য ভিটামিনগুলো শ্বেতসার মেটাবলিজমে ও হাড়ের গঠনে ফসফরাস এবং ভিটামিনকে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে ও বৃদ্ধদের আলঝেইমা রোগ প্রতিরোধ করে।
 
উৎপাদন প্রযুক্তি
আলুবোখারা বা রোজেসি পরিবারভুক্ত একটি ফল জাতীয় মসলা ফসল। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক জাতগুলোর বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় এবং ফল বিভিন্ন সময়ে ধরে থাকে। যেমন- তাইওয়ানে জানুয়ারিতে, যুক্তরাষ্ট্রে এপ্রিল মাসে ফুল ফোটে। এর ফল মধ্যমাকৃতির ১-৩ ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যাসযুক্ত, গোলাকার ও ওভাল হয়।
 
আবহাওয়া ও মাটি
সাধারণত শীতপ্রধান ও অবউষ্ণ আবহাওয়া আলুবোখারা চাষের জন্য উপযোগী। তার ০-৭.২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী। অবউষ্ণ এলাকার জন্য শীতকালে শৈত্যায়ন হয়ে শীতের পর ফুল আসে এবং ফলধারণ করে। আলুবোখারা রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ও সুনিষ্কাশিত উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। পাহাড়ের ঢালে ও পাহাড়ের উপরে ভালো বায়ু চলাচল উপযোগী ও পর্যাপ্ত সূর্যালোকে এর উৎপাদন ভালো হয়।
 
জমি তৈরি
যে জমিতে অন্য ফসল ভালো হয় না সে জমি আলুবোখারা চাষের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। বাগান আকারে চাষ করতে হলে নির্বাাচিত জমি ভালো করে চাষ ও মই দিয়ে সমতল এবং আগাছামুক্ত করে দিতে হবে। পাহাড়ি এলাকা, বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধার বা পুকুর পাড়ে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে জমিতে চাষ না দিয়ে শুধু পারিষ্কার করে নিলেই চলবে।
 
জাত : বারি আলুবোখারা-১
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত বারি আলুবোখারা-১ জাতটি ২০১৩-১৪ সনে অনুমোদন করা হয়। এদেশের মাটিতে ভালো ফলন দিচ্ছে। এর গাছ মাঝারি আকারের, ৫-৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে শাখা ছাটাই না করলে এর গাছ ১২ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে। ফেব্রুয়ারি মাসে এ জাতটিতে ফুল আসে আর জুন মাসে ফল পাকে। আকর্ষণীয় উজ্জ¦ল লাল রঙের মাঝারি আকারের (৮.৬৬ গ্রাম/ফল) সুগন্ধিযুক্ত ফল। এর ফলের খাদ্যাংশ বেশি (৯৭%) এবং মাঝারি টক মিষ্টি স্বাদের (টিএসএস ১১.০)। গাছে প্রচুর ফল ধরে  (গড়ে ১৪০০টি), ১১.৩ কেজি বা হেক্টরপ্রতি ৭.০৩ টন। এ জাতটিতে রোগ বালাই এর আক্রমণ অনেক কম।
 
রোপণ পদ্ধতি ও সময়
সমতল ভূমিতে আলুবোখারা চারা সাধারণত বর্গাকার বা ষড়ভূজী প্রণালিতে লাগানো যায়। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ে কণ্টুর রোপণ প্রণালি অনুসরণ করতে হবে। মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত আলুবোখারা চারা রোপণ করা যায়।
 
মাদা তৈরি
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উভয় দিকে ৩-৪ মিটার দূরত্বে ৬০x৬০x৬০ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত করতে হবে। প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি কম্পোস্ট বা পচা গোবর, ৩-৫ কেজি ছাই, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করে গর্তের উপরের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।
 
চারা-কলম রোপণ ও পরিচর্যা
এক বছর বয়সী সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা-কলম রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে। গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা-কলমটি গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগিয়ে তারপর চারদিকে মাটি দিয়ে চারার গোড়ায় মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে। রোপণের পরপর খুঁটি দিয়ে চারা-কলমটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। অতঃপর প্রয়োজনমতো পানি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
 
গাছের সার প্রয়োগ
সারের নাম    গাছের বয়স
                      ১-৩ বছর    ৪-৭ বছর    ৮-১০ বছর   ১০ বছর এর ঊর্ধ্বে
গোবর/কম্পোস্ট  ১০-১৫         ১৫-২০         ২০-২৫       ২৫-৩০
ইউরিয়া(গ্রাম)    ২০০-৩০০    ৩০০-৪০০    ৫০০-৮০০    ১০০০
টিএসপি (গ্রাম)    ১৫০-২০০    ২০০-৩০০    ৩০০-৪০০    ৫০০
এমওপি (গ্রাম)    ১৫০-২০০    ২০০-৩০০    ৩০০-৪০০    ৫০০
 
আশানুরূপ গুণগতমানসম্পন্ন ফল পেতে হলে আলুবোখারা নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছের বৃদ্ধির সাথে সারের পরিমাণ বাড়বে। প্রতিটি গাছের জন্য সারের পরিমাণ হবে।
 
সবটুকু সার ৩ ভাগ করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র-আশ্বিন ও মাঘ-ফাগুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার দেয়ার পর প্রয়োজনে পানি দিতে হবে।
 
আগাছা দমন
গাছের গোড়া নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পাহাড়ের ঢালে, বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধার বা পুকুর পাড়ে লাগানো গাছের গোড়ায় আগাছা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে।
 
সেচ প্রয়োগ
চারা রোপণের প্রথমদিকে প্রয়োজনমতো সেচ দেয়া দরকার। খরা বা শুকনো মৌসুমে পানি সেচ দিলে ফল ঝরা কমে, ফলন বৃদ্ধি পায় এবং ফলের আকার ও আন্যান্য গুণাগুণ ভালো হয়।
 
ডাল ছাঁটাইকরণ
চারা অবস্থায় গাছকে সুন্দর কাঠামো দেয়ার জন্য অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করে রাখতে হবে। ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ও পোকামাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে।
 
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
বারি আলুবোখারা-১ এ রোগ বালাই তেমন দেখা যায়নি। শুধুমাত্র পাতার দাগ বা লিফ স্পট রোগ দেখা গেছে। রিডোমিল বা এ জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করেই তা দমন করা যায়।
 
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
আলুবোখারার ফল নন-ক্লাইমেক্টরিক হওয়ায় গাছ থেকেই ভালোভাবে পাকার পর তা সংগ্রহ করতে হয়। আলুবোখারার ফল ভালোভাবে পেকে গাঢ় লাল বা হালকা খয়েরি রঙ ধারণ করলে এবং ফল নরম হলেই সংগ্রহ করা উচিত। হালকা লাল বা হলুদ আবস্থায় সংগ্রহ করা হলে তা অত্যন্ত টক বা হালকা তেতো স্বাদেরও হতে পারে। বারি আলুবোখারা -১ এর বা এ জাতের প্রতি পূর্ণবয়স্ক (১৫-২০ বছর) গাছে দেড় থেকে তিন হাজার পর্যন্ত ফল পাওয়া যেতে পারে। হেক্টরপ্রতি ৭ থেকে ১০ টন সতেজ পাকা ফল পাওয়া যায়।

No comments:

Post a Comment

লাবাং